থাইরয়েড হলে কি কি সমস্যা হয় বিস্তারিত জেনে নিন
থাইরয়েড হলো ছোট একটা গ্রন্থি, যা ঘাড়ের সামনের দিকে শ্বাসনালীর চারপাশে আবৃত থাকে। এর আকৃতি অনেকটা প্রজাপতির মতো, মাঝখানে ছোট দুটি ডানা আছে। আমাদের শরীরে অনেকগুলো গ্রন্থি আছে, এগুলো আমাদের শরীরে একটা নির্দিষ্ট কাজ করতে সহায়তা করে৷ থাইরয়েড তেমনি একটা গ্রন্থি।
থাইরয়েড গ্রন্থির কাজ মূলত আমাদের শরীরের কিছু অত্যাবশকীয় হরমোন (থাইরয়েড হরমোন) উৎপাদন করা। শরীরে এই থাইরয়েড হরমোনের আবার একটা নির্দিষ্ট মাত্রা আছে। নির্দিষ্ট মাত্রার চাইতে কম বা বেশি হরমোন উৎপাদিত হলেই শরীরে এর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।
আরম্ভঃ
শরীরে থাইরয়েড হরমোন কম উৎপন্ন হলে বলা হয় হাইপোথাইরয়েডিজম এবং বেশি উৎপন্ন হলে বলা হয় হাইপারথাইরয়েডিজম। থাইরয়েড সমস্যা হলে শরীরে কিছু পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। এ সম্পর্কে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করবো।
থাইরয়েড হলে কি কি সমস্যা হয়
- ক্লান্তি ক্লান্তি ভাব
- অল্পতেই শীত শীত লাগবে
- কোষ্ঠকাঠিন্য
- ত্বক শুষ্ক হয়ে যাওয়া
- হঠাৎ করে অস্বাভাবিক ওজন বৃদ্ধি পাওয়া বা কমে যাওয়া
- অনেক সময় মুখ ফুলে যেতে পারে
- গলার স্বর বদলে যেতে পারে
- পেশীর দুর্বলতা
- পেশীতে ব্যথা
- নারীদের ক্ষেত্রে ঋতুস্রাব পরিবর্তন হয়ে যাওয়া
- ডিপ্রেশন
- চুল পড়ে যাওয়া বা চুল পাতলা হয়ে যাওয়া
- স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া
আরও পড়ুনঃ মেয়েদের বন্ধ্যাত্বের লক্ষণ
থাইরয়েড কি কারণে হয়
থাইরয়েড রোগের ২টি প্রধান ধরন হল হাইপোথাইরয়েডিজম এবং হাইপারথাইরয়েডিজম। উভয় অবস্থাই অন্যান্য রোগের কারণে ঘটতে পারে, যা থাইরয়েড গ্রন্থির কাজকে প্রভাবিত করে। নানা কারণে এই সমস্যা হতে পারে।যেমন –
- আয়োডিনের অভাব
- শরীরে অন্যান্য গ্রন্থির ঠিক করে কাজ না করা
- থাইরয়েড গ্রন্থির জন্মগত ত্রুটি
থাইরয়েড বেশি হলে কি হয়
হাইপার-থাইরয়ডিজমঃ থাইরয়েড হরমোন নিঃসরণ বেড়ে গেলে শরীরে যেসব উপসর্গ দেখা দেয়, তা হলো
- ওজন কমে যাওয়া,
- বুক ধড়ফড় করা,
- অতিরিক্ত ঘাম নিঃসরণ,
- গরম সহ্য করতে না পারা,
- গা গরম থাকা,
- ঘন ঘন পায়খানা হওয়া,
- হাতে কাঁপুনি,
- ঘুম না হওয়া,
- অতি–উদ্বেগ,
- চোখ কোটর থেকে যেন বেরিয়ে আসা ইত্যাদি।
আরও পড়ুনঃ মেয়েদের ফর্সা হওয়ার প্রাকৃতিক উপায়
কি খেলে থাইরয়েড নিয়ন্ত্রণ রাখে।
আসুন, একে একে তা জেনে নিই–
- আমলকীঃ যে কোনো টক ফলের তুলনায় আমলকীতে আট গুণ বেশি ভিটামিন সি থাকে, যা রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ায়। তাই নিয়মিত আমলকী খাওয়ার অভ্যাস থাইরয়েডজনিত সমস্যাকে নিয়ন্ত্রণে রাখে।
- কুমড়া বীজঃ কুমড়ার বীজে রয়েছে জিঙ্ক। এই জিঙ্ক শরীরের অন্যান্য ভিটামিন এবং খনিজগুলোকে শোষণ করতে সাহায্য করে। একই সঙ্গে শরীরে থাইরয়েড হরমোন সংশ্লেষণ করে একটি ভারসাম্য বজায় রাখে।
- ব্রাজিল নাটঃ থাইরয়েড হরমোনের প্রয়োজন সেলেনিয়ামের। এটি একটি মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট যা শরীরে থাইরয়েড হরমোনের বিপাক সংগঠিত হওয়ার জন্য বিশেষভাবে প্রয়োজন। ব্রাজিল বাদাম সেলেনিয়ামের সেরা প্রাকৃতিক উৎসগুলোর মধ্যে একটি। চিকিৎসকের মতে, দিনে মাত্র তিনটি ব্রাজিল নাট খেলেই শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণ অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট তৈরি হবে; যা থাইরয়েড মিনারেল সরবরাহ করতে পারে।
- মুগ ডালঃ মুগ ডালে আছে প্রোটিন, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, জটিল কার্বোহাইড্রেট, প্রচুর ভিটামিন এবং খনিজ। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই ডালে ফাইবারের পরিমাণও বেশি। কোষ্ঠকাঠিন্য হলো থাইরয়েড ভারসাম্যহীনতার একটি সাধারণ লক্ষণ। তাই ফাইবারজাতীয় খাবার খেলে এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সহজ হবে।
- নারকেলঃ থাইরয়েড রোগীদের জন্য অন্যতম কার্যকর খাবার হতে পারে ডাব অথবা নারকেল। নারকেল বিপাক প্রক্রিয়াকে উন্নত করে। যার ফলে খাবার ভালোভাবে হজম হয়। এটি থাইরয়েড নিরাময়ের একটি মহৌষধ।
থাইরয়েড কি খাওয়া যাবে না
- বাধাকপি ,
- ফুলকপি ,
- ব্রকোলি,
- ছোলা থাইরয়েডের সমস্যা বাড়িয়ে তোলে, তাই সতর্ক থাকুন।
- থাইরয়েড বেড়ে গেলে দুগ্ধজাত খাবার, যেমন পনির, চিজ ডায়েট থেকে বাদ দিন।
- চিনি,
- রান্না করা গাজর,
- মধু,
- ময়দার রুটি,
- সাদা পোস্ত,
- মিষ্টি শরীরে কার্বোহাইড্রেটের মাত্রা বাড়ায়।
- থাইরয়েড থাকলে এগুলি কম খান।
থাইরয়েড হলে কি বাচ্চা হয় না
থাইরয়েডের নানা রকম সমস্যার মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত হলো হাইপোথাইরয়েডিজম বা থাইরয়েড হরমোন ঘাটতিজনিত রোগ। থাইরয়েড–সংক্রান্ত রোগ ব্যাধিগুলোর মধ্যে এই রোগে সর্বাধিক মানুষ আক্রান্ত হয়ে থাকেন। পুরুষদের তুলনায় নারীদের মধ্যে এ রোগের আধিক্য বেশি। পুরুষ ও নারীদের প্রজননস্বাস্থ্যে থাইরয়েড হরমোনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
ক্ষেত্রবিশেষে হরমোনটির তারতম্যের কারণে বন্ধ্যাত্ব পর্যন্ত হতে পারে। গর্ভকালীন মা ও গর্ভস্থ শিশুর নানাবিধ জটিলতা দেখা দিতে পারে। যাঁদের থাইরয়েডের সমস্যা আছে, তাঁরা একটা উদ্বেগের মধ্যে থাকেন, তাঁরা মা হতে পারবেন কিনা। অবশ্যই পারবেন, তবে তাঁর জন্য চাই সচেতনতা।
গর্ভের প্রথম ধাপে গর্ভস্থ ভ্রূণের বিকাশ ও বৃদ্ধির জন্য নিজস্ব কোনো থাইরয়েড হরমোন থাকে না। এটির জন্য মায়ের ওপর গর্ভস্থ শিশুটি নির্ভরশীল। মায়ের হরমোন ঘাটতি তাই শিশুর স্নায়বিক বৃদ্ধি ও বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। শিশু হতে পারে বুদ্ধি বৈকল্যের শিকার।
অনেক ক্ষেত্রে এর ঘাটতির কারণে গর্ভপাত হতে পারে। এ ছাড়া অকাল প্রসব, চব্বিশ সপ্তাহ পর গর্ভের ভেতর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এসব বাচ্চারা সাধারণত জন্মগতভাবে কম ওজনের হয়ে থাকে। কখনো গর্ভস্থ শিশু হতে পারে জন্মগত হাইপোথাইরয়েডিজম আক্রান্ত।
থাইরয়েড নরমাল কত
থাইরয়েড পরীক্ষা বা TSH পরীক্ষার জন্য স্বাভাবিক মাত্রা:
- প্রথম ত্রৈমাসিক: 0.3-5 mIU/L.
- দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক: 0.3-6 mIU/L.
- তৃতীয় ত্রৈমাসিক: 0.7-2 mIU/L.
থাইরয়েড কমানোর উপায়।থাইরয়েড কমানোর ঘরোয়া উপায়
থাইরয়েড কমানোর উপায় বা থাইরয়েড কমানোর ঘরোয়া উপায় গুলো নিম্নে আলোচনা করছি।
- প্রথমেই বাইরের প্রক্রিয়াজাত খাবার এবং কৃত্রিম খাবার যাতে চর্বি, লবণ, কার্বনেটসহ ক্ষতিকারক উপাদান বেশি থাকে পরিহার করতে হবে।এগুলো স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর এবং নিয়মিত এগুলো খাওয়ার ফলে শরীরে অনেক খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে।
- অগোছালো জীবনযাপন পরিহার এবং জীবনযাত্রা ঠিক করতে হবে। বর্তমানে ন শারীরিক ও মানসিক সমস্যা হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে এটি। স্বাস্থ্য ভালো রাখতে নিয়মিত ব্যায়াম করা অত্যন্ত জরুরি। শরীরের অতিরিক্ত ক্যালোরি কমাতে এবং শরীর সুস্থ রাখতে নিয়মিত ব্যায়ামের বিকল্প নেই।
- তাই খাওয়ার সময় কখনও তাড়াহুড়ো না করে, সময় নিয়ে ভালো করে চিবিয়ে খেতে হবে। শরীরের বিপাক নিয়ন্ত্রণে থাইরয়েড গ্রন্থি বিশেষ ভূমিকা পালন করে, এই জন্য সময় নিয়ে খাবার চিবিয়ে খেলে তা বিপাক ক্রিয়া বাড়াতে বিশেষভাবে সাহায্য করে।
- গবেষকেরা বলেন, বাঁধাকপি, ব্রকলি, ব্রাসেলস স্প্রাউট, ফুলকপি ইত্যাদি এগুলো কাঁচা অবস্থায় খাওয়া ঠিক নয়। এগুলো কাচা খেলে থাইরয়েড গ্রন্থির কাজ ব্যাহত হয়ে থাকে এবং থাইরয়েড গ্রন্থির ভারসাম্য নষ্ট হয়। এই কারণে এই সবজি গুলো কাঁচা অবস্থায় বা স্যালাদ হিসেবে না খেয়ে রান্না করে খেতে হবে।
- নারকেল তেল গরম না করে ব্যবহার করলে তা ওজন কমাতে এবং বিপাকীয় ক্রিয়া বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করে। নারকেল তেলে যে ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে তা থাইরয়েড গ্রন্থির কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করে।এছাড়া শরীরের তাপমাত্রাও ঠিক রাখতেও এই তেল অত্যন্ত কার্যকরি।
- হরমোন উৎপাদনের ভারসাম্যতা বজায় রাখতে অ্যাপেল সিডার ভিনেগার অনেক উপকারী। এতে বিপাক ক্রিয়ার উন্নতি হয়। এ ছাড়াও এটি শরীরের ফ্যাট নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং শরীর থেকে বিভিন্ন বিষাক্ত পদার্থ বের করে পুষ্টি শোষণে সহায়তা করে।
- আদাতে বিভিন্ন রকম খনিজ যেমন- পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম থাকে। তাই এটি থাইরয়েডের সমস্যার জন্য অনেক কার্যকর। থাইরয়েডের সমস্যা নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত আদা চা পান করা অনেক উপকারী।
- থাইরয়েডের সমস্যা নিয়ন্ত্রণে ভিটামিন বি খুবই সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তাই যেগুলো খাবারে এই ভিটামিন বেশি থাকে যেমন, ডিম, মাছ, মাংস, দুধ, বাদাম এগুলো প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় অন্তভুর্ক্ত করতে হবে যাত এগুলি শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন বি সরবরাহ করতে পারে।
- ভিটামিন ডি এর অভাবে থাইরয়েডের সমস্যা হয়ে থাকে।সূর্যের আলোতেই শরীর ভিটামিন ডি প্রস্তুত করতে পারে। তাই দিনে ১৫ মিনিট সূর্যের আলোয় থাকতে হবে। এতে শরীরে ভিটামিন ডি প্রস্তুতসহ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়বে। ভিটামিন ডি বেশি পরিমাণে থাকে এমন কিছু খাবার হচ্ছে- স্যালমন, ম্যাকারেল, দুগ্ধজাতীয় দ্রব্য, কমলালেবুর রস, ডিমের কুসুম ইত্যাদি।
- আয়োডিন ও খনিজসমৃদ্ধ খাবার থাইরয়েডের জন্য অনেক বেশি উপকারী। শতাই যে খাবারে এই উপাদানগুলো বেশি থাকে যেমন, দুধ, পনির, দই এই ধরনের দুগ্ধজাতীয় খাবার থাইরয়েডের জন্য অনেক বেশি উপকারী। আয়োডিন সাপ্লিমেন্টও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
পরিশেষঃ
থাইরয়েড সমস্যাগুলি নিয়মিত মনিটরিং এবং চিকিৎসা দ্বারা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা নিয়মিত পরীক্ষা করা এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া উচিত। যদি চিকিৎসা সময়মতো শুরু করা হয় এবং নিয়মিত মনিটরিং করা হয়, তাহলে থাইরয়েড সমস্যাগুলি নিয়ন্ত্রণে রেখে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করা সম্ভব।
আমাদের ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url